দাদার হঠাৎ বিয়ে, তাকে প্রথম দেখা

জয় প্রিয়া 'র অনলাইন ডাইরী - প্রথম দেখা
৩ জুলাই ২০০৯ এর দুপুর! নিজের রুমে ভাল ছাত্রের মত নোট খাতায় চোখ বুলাচ্ছিলাম। ভর দুপুরে এই দৃশ্য কেউ দেখা মাত্রই মন্তব্য করে বসবে, "আহা সোনার টুকরো ছেলে"। কিন্তু আমার জননী ভাল করেই জানেন, পরীক্ষা না এলে ছেলের এই দৃশ্য কোটি টাকা দিয়েও দেখানো সম্ভব না।

আমার পড়তে পড়তে বিছানায় শুয়ে পড়া অভ্যাস, বেশীক্ষণ ভদ্রতা দেখাতে পারিনা। শুয়ে শুয়ে আনমনে কি যেন একটা ভাবছিলাম এমন সময় বাদুরগাছা থেকে আড়াই কিলো বাইসাইকেল হাঁকিয়ে বড় পিসেমশায় আমাদের বাড়িতে এসে পৌঁছালেন। নিশ্চয় কোন গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। দেওয়ালের সাথে নিজের বা কানটা যথা সম্ভব চেপে ধরে বাইরের আলোচনা শুনবার চেষ্টা করলাম। মা কাকীমার সাথে পিসেমশায় বলছে, "ভাগ্নের তো হঠাৎ বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। তোমাদের সবাইকেই যেতে হবে। গুছিয়ে নাও তাড়াতাড়ি"। 

দাদার বিয়ের কথা চলছে গত কয়েকদিন ধরে। আমাদের বাড়িতে আলোচনা হয়েছে শুনেছি। তবে আমি কখনও আগ্রহ নিয়ে কিছু জিগেস করিনি। বারান্দা থেকে পিসেমশায় আমার নাম উচ্চারণ করতেই আমি দেওয়াল থেকে কানটা সরিয়ে নিলাম। এরপর উনার সামনে গিয়ে একগাল হাসবার ব্যার্থ চেষ্টা করে বললাম, "ভালো আছেন?"। উনি বললেন

- দাদার বিয়ে, তোকে কিন্তু যেতে হবে।
=> কিন্তু আমার যে বিকাল সাড়ে তিনটায় প্রাইভেট রয়েছে।
- ও একদিন না গেলে কিছু হবেনা। 
=> না মানে সামনে পরীক্ষা তো। এখন বন্ধ করা ঠিক হবেনা।
- ঠিক আছে, তাহলে একবারে গুছিয়ে বের হবি। তারপর প্রাইভেট শেষ করে ওখানে চলে যাবি।
=> আচ্ছা।

যথা সময়ে প্রাইভেট পড়া শেষ করে উনাদের বাড়ি গিয়ে পৌছালাম। অনেক আত্নীয় স্বজন এসেছেন। আমার পরিবারের সবাইও যথা সময়ে পৌঁছে গেছেন। তেমনই কথাবার্তা ছিল। বেশী মানুষজন, হৈ-হুল্লোড়, বড় অনুষ্ঠান এসবে আমাদের যেতে ভাল লাগেনা কখনও। মনে হচ্ছিল না এলেই বোধহয় ভাল হত। পিসিমারা, পিসতুতো ভায়েরা ছিল, তাদের সাথেই সময় কাটাতে লাগলাম।

মশারা নিজেদের ঘর ছেড়ে, মিষ্টি খেকো মানবজাতির ঘরে ঢুকে সবে কামড়াতে শুরু করেছে এমন সময় আমরা তিনটা মাইক্রোবাস যোগে কনের বাড়ির উদ্দেশ্য বেরিয়ে পড়লাম। গ্রামের আঁকা বাকা, আর কাঁচা পাকা রাস্তা দিয়ে মাইক্রোবাস গুলো পাল্লা দিয়ে চলতে শুরু করল। প্রতিবার তারা টার্ন নিচ্ছিল আর আমি জানালার কাঁচের সাথে বাড়ি খাচ্ছিলাম। 

এভাবে বাড়ি খেতে খেতে আমরা যখন কনের বাড়ি পৌছালাম তখন ঘড়ির কাটা রাত ৯ টা থেকে মাত্র ৫ মিনিটের দূরত্বে। আর মশারাও পুরো দমে কামড়ানো শুরু করে দিয়েছে। তারই মধ্যে বসবার ব্যবস্থা হল, নাস্তা শেষ হল। কিছুক্ষণ পর মা কাকীমা, আর পিসিমারা কনের ঘরের দিকে ছুটলো তার মুখদর্শন করবে বলে। আমি কোন আগ্রহ না দেখিয়ে বরাবরের মত মশার কামড় উপভোগ করতে লাগলাম। 

এরই মধ্যে ছোট পিসিমার বড়ছেলে (আমার থেকে বয়সে ছোট) কোথা থেকে উড়ে এসে আমার পিঠে চড় বসিয়ে বলল, "চল দাদা বউদিকে দেখে আসি। সবাই যাচ্ছে। আমারা বাদ থাকি কেন?" অগ্যতা তাকে নিয়ে চললাম কনের ঘরের দিকে। দরজায় মা আমাকে দেখে বলল, ভিতরে আয়। ভিড় ঠেলে ভিতরে পৌঁছে সবাই বিয়ের কনেকে দেখলেও আমার নজর আটকে গেল অন্য একজনের দিকে। তিনি কনের পাশে মাথা নিচু করে লাজুক মুখে বসে আছেন। তাকে নিয়েই এই লেখা, ভবিষ্যৎ লেখা গুলোর মধ্যমণিও তিনি। তিনি এখনও আমার বর্তমান।

কনে দেখা শেষ করে ভাইদের সাথে আশপাশ টা একটু ঘুরলাম। বউদিদের বাড়ির পেছন দিয়ে একটা নদী বয়ে গেছে। রাত না হলে নদীর পাড়ে গিয়ে হয়ত কিছুক্ষণ বসে থাকতাম। নদী আমার ভীষণ প্রিয়। 

খাওয়া দাওয়ার পর্ব শেষ করে মুল বিয়ের অনুষ্ঠান শুরু হল রাত ১১ টায়। রাত জেগে কোন অনুষ্ঠান দেখাতে আমি অভ্যস্ত না, ভালও লাগেনা। কিন্তু নতুন জায়গা, কোথায় গিয়ে ঘুমাবো! হয়ত বিয়ে শেষ হবার পরেই বরযাত্রীদের শোবার জায়গার ব্যবস্থা করা হবে। তাই ছাত্নাতলার একপাশে বসে বিয়ের অনুষ্ঠান দেখতে লাগলাম।

এর মাঝে হঠাৎ বিদ্যুত চলে গেল। IPS এ কয়টা কম ওয়াটের টিউব লাইট জ্বলছে। গ্রাম গঞ্জে এলইডির আলো তখনও পৌঁছায়নি। এমন অল্প আলোতে পুরো পরিবেশটা পূর্ণিমার রাতের মত লাগছিল। রাতের কোমল আলোতে কিছু রং যেমন দূর থেকে দৃষ্টি কাড়ে তেমনি একটা রঙ আমার বিপরিত পাশে দেখতে পাচ্ছিলাম। মাথা তুলে সামনে তাকালাম, ছাত্নাতলার ওপাশের বারান্দায় একজন মুখে হাত দিয়ে বসে আছে। সেই মায়াবিনী যাকে আমি কনের ঘরে দেখেছিলাম।

সে দুধের মত পরিষ্কার নয়, কিন্তু যতটুকু রং একজনকে সুন্দর দেখাবার জন্য প্রয়োজন তার সবটুকুই তার আছে। তার মায়াবী দৃষ্টি, আমি চাইলেও তার থেকে চোখ ফেরাতে পারছিলাম না। কিছুক্ষণ পর সে বারান্দা থেকে উঠে এসে ছাত্নাতলার ওপাশে আমার সামনে বসল। এবার আমি তাকে পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছিলাম। মাত্র কয়েক ফুটের দূরত্ব। 

এভাবে অনেকটা সময় পার হয়ে গেল। বিয়ের অনুষ্ঠান প্রায় শেষ পর্যায়ে, তখনও কারেন্ট আসেনি। প্রতিবেশীরা আস্তে আস্তে যে যার বাড়ি ফিরে যাচ্ছে। আমি তার দিকে তাকিয়ে আছি, হয়ত সেও এবার নিজের বাড়ি ফিরে যাবে। লক্ষ্য করলাম তার দুপাশে বসা আমাদের বরযাত্রীর দুইটা ছেলে তাকে বিরক্ত করছে। এক পর্যায়ে সে উঠে দাঁড়ালো, কিন্তু আমার দৃষ্টি তাকে ছাড়তে চাচ্ছিলনা। আমার সামনে দিয়ে সে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। রাত ১২ টায় আমি তাকে হারালাম। 

বিয়ের অনুষ্ঠান শেষে বরযাত্রীদের শোবার ব্যবস্থা করা হল। রুমে যাবার পূর্ব মুহুর্ত পর্যন্ত আমার দৃষ্টি চারিদিকে তাকেই খুঁজছিল! কিন্তু সে আর এলোনা। কি নাম? কোথায় থাকে? কিসে পড়ে?... প্রশ্ন গুলো আগামীকাল সকালের জন্য রেখে দিলাম। 

ঘুম আসছিল না। জীবনে এই প্রথম নতুন কিছু অনুভূতি অনুভব করতে লাগলাম। বার বার, আমার তার কথায় মনে পড়ছিল। মন চাচ্ছিল সে আমার সামনে এসে বসে থাকুক, আমি শুধুই তাকে দেখতে থাকব। প্রচন্ড মশার কামড় আর তাকে নিয়ে নানান চিন্তা-ভাবনা, মোটেও ভাল ঘুম হলোনা।

সকালে ঘুম থেকে উঠে অনেকক্ষণ নদীর পাড়ে কাটালাম। নদীর পাড়ে বসলে আমি নিজেকে হারিয়ে ফেলি। মনে হয় সারাবেলা এখানে কাঁটিয়ে দিই। ছোট ভায়ের ডাকে ফিরে গেলাম। বাবা বললেন গুছিয়ে নাও, আমাদের ফিরতে হবে।

মাইক্রোবাসের জানালা দিয়ে শেষবার বাইরে তাকালাম, চারিদিকে কত মানুষ! কিন্তু সে কোথাও নেই। খুব খারাপ লাগল, ভেবেছিলাম অন্তত কনে বিদায়ক্ষণে তাকে আবার দেখতে পারব। দেখা হলনা। ফিরবার পুরো সময়টা জুড়ে মনে হচ্ছিল, আমি তাকে ফেলে রেখে চলে যাচ্ছি। সে আমার সাথে ছিল, তার সাথে আমার বন্ধন জন্ম-জন্মান্তরের। 

Comments

Popular posts from this blog

ফিরে আসা, তাকে ভাল লাগার কথা জানানো

তার মনে একটুখানি জায়গা পাওয়া, দ্বিতীয় কথা

দূর্গাপূজার নবমী, প্রিয়ার সাথে তৃতীয় কথা

প্রিয়ার সাথে প্রথম কথা, স্বপ্ন পূরণ